বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য পরিণতি

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য পরিণতি বর্তমান সময়ের একটি আলোচ্য বিষয়। এই ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেকের সামগ্রিক জ্ঞান থাকা জরুরী। এই পোস্টে এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য পরিণতি
বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে বাংলাদেশের আবহাওয়াতে এসেছে বিশাল পরিবর্তন এর প্রভাবে জনসাধারণের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছেচলুন জেনে নেওয়া যাক বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে। 

ভূমিকা

বিশ্ব উষ্ণায়নের পরিবর্তন মানব জীবনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এই সম্পর্কে জানা আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য আমাদের আলোচ্য অংশে বিশ্ব উষ্ণায়ন কি, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব, বাংলাদেশে এ বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে

বিশ্ব উষ্ণায়ন 

উষ্ণায়নের আরেক নাম তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে বুঝি বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বর্তমান সময়ে যা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করছে। এর প্রভাবে আমরা একটি কঠিন সময় পার করছি।এর প্রভাবে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য পরিণতি ভয়াবহ।

বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ 

বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান কারণ বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউজ গ্যাসের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এই গ্যাসের মধ্যে রয়েছে নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরোকার্বন এবং ওজন। গ্রীন হাউজ গ্যাসের বৃদ্ধির কারণ শিল্পযুগে মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির দহন।
আরও পড়ুনঃ



বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব 

সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি :বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে এন্টার্কটিকা মহাদেশের বরফ গলতে শুরু করেছে যার দরুন প্রতিবছরই সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক একটা ঘটনা যা আমাদের চিন্তায় ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বরফ খন্ড যার নাম (A23a) যার আয়তন প্রায় চার হাজার স্কয়ার কিলোমিটার যা বাংলাদেশের আয়তনের তিনভাগের একভাগ তা মূল জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে সাগরে ভাসছে।

                                  
IPCC(The Intergovermental Panel on Climate Change) এর মতে বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়তে থাকলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে সমুদ্রের পানির পৃষ্ঠের উচ্চতা ২০ থেকে ৮০ সেমি বৃদ্ধি পাবে। যার ফলপ্রসু অনেক সমুদ্রতীরবর্তী দেশ বা সমুদ্রতীরবর্তী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সাগরে তলিয়ে যাবে।যার মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে।

জলবায়ুর পরিবর্তন : পৃথিবীর উষ্ণতম বছর গণনা করা হয় ১৯৯৫ সাল থেকে। পূর্ববর্তী শতকগুলির তুলনায় সাইবেরি অঞ্চলের তাপমাত্রা তিন থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ।ইউরোপের আল্পস পর্বতের অর্ধেক বরফ ১৮৫০ সালের পর থেকে গলে গিয়েছে। IPCC এর রিপোর্টে বলা হয়েছে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ০.৬ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০ সেমি বৃদ্ধি পেয়েছে।

এন্টার্কটিকায় পেঙ্গুইন এবং ক্রীল জাতীয় এক প্রকার সামুদ্রিক মাছ যা প্রাণীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে সেগুলো কমে যাচ্ছে কারণ মেরু অঞ্চলের সামুদ্রিক জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চল যেখানে আগে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি ছিল সেখানে বর্তমান সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেছে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে। আরো উষ্ণ ও শুষ্ক হচ্ছে ক্রান্তীয় অঞ্চল গুলি।

হিমবাহের গলন : হাজার হাজার বছর ধরে জমতে থাকা মেরু অঞ্চলের হিমবাহ চূড়া গলতে শুরু করেছে এবং এই বরফ গলার হার এত বেশি যে ৮০ বছরের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বরফ পুরোপুরি গলে যাবে। এন্টার্কটিকায় বহু বছর ধরে জমে থাকা বিশাল বিশাল বরফ খন্ড আজ গলতে শুরু করেছে। হিন্দুকুশ পর্বতমালার বরফ অর্ধেক গলে যাবে যদিওবা বিশ্ব উষ্ণায়নের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর মধ্যে আটকে রাখা যায়।

বন্যার সম্ভাবনা বৃদ্ধি : বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে যেমন ঝড়,বন্যা প্রভৃতি। বাংলাদেশ এখন প্রত্যেক বছর বিভিন্ন অঞ্চল বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে যা মানুষের দুর্ভোগ দিন দিন বাড়াচ্ছে এর ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সাধন হচ্ছে।

খরার সম্ভাবনা বৃদ্ধি : বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টির পরিমাণ কমে গেছে ফলে সেখানে খরার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। খরার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ফসল জমিতে ভালো মানের ফসল হওয়া সম্ভবনা কমে গেছে যার দরুন একটি দেশের অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়ছে।

তাপ প্রবাহ: বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে আবহাওয়া জনিত অনেক দুর্যোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে তার মধ্যে তাপ প্রবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। উষ্ণপ্রান্তীয় অঞ্চল গুলোর মধ্যে তাপ প্রবাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে । এর ফলে মানুষের প্রাণহানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২৩ সাল বিশ্বের উষ্ণতম বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে

২০২৩ সালকে খুবই সম্ভবত গত ১,০০,০০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ বছর হিসেবে রেকর্ড করা হয়। এ দাবি করেছে কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু সংস্থা ২০২৩ সালকে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হিসেবে রেকর্ড করেছেন গত ১,০০,০০০ বছরের মধ্যে। 

জলবায়ুর রেকর্ড যখন ভেঙ্গে যাচ্ছিলো তখন বিজ্ঞানীরা এই মাইলফলকটির বেপারে শঙ্কিত ছিলেন। জুনের পর থেকে, আগের বছরের একই মাসের তুলনায় প্রতি মাস রেকর্ডে বিশ্বের সবচেয়ে গরম হয়েছে। 

কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (C3S) এর ডিরেক্টর কার্লো বুওনটেম্পো বলেছেন, "এটি জলবায়ু অনুসারে একটি খুব ব্যতিক্রমী বছর ছিল নিজস্ব একটি লীগে এমনকি অন্যান্য খুব উষ্ণ বছরের তুলনায়।" ১৮৫০ সালের পর থেকে ২০২৩ সালকে উষ্ণতম বছর হিসাবে নিশ্চিত করেছে C3S। 

আমাদের পৃথিবী ১৮৫০-১৯০০ সময়ের তুলনায় ২০২৩ সালে ১.৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২.৬৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেশি উষ্ণ ছিল। এরপরেও মানুষ শিল্প স্কেলে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছে এবং বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড পাম্প করছে। 

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে দেশগুলি সম্মত হয়েছিল যে বিশ্ব উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতিক্রম করা থেকে প্রতিরোধের চেষ্টা করতে হবে এবং এর জন্য দায়ী গুরুতর পরিণতিগুলি এড়াতে হবে। বিশ্ব সেই লক্ষ্যমাত্রা লঙ্ঘন না করলেও ২০২৩ সালের প্রায় অর্ধেক দিনের তাপমাত্রা সেই মাত্রা অতিক্রম করে একটি ভয়ানক নজির স্থাপন করেছে। 

এর ফলে এই  বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য পরিণতিও ভয়াবহ। ২০২৩ সালে কয়লা, তেল এবং গ্যাস পোড়ানো থেকে বিশ্বের CO2 নির্গমন রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে। C3S বলেছে ২০২৩ সালে CO2 এর ঘনত্ব সর্বোচ্চ স্তরে বেড়েছে যা প্রতি মিলিয়নে ৪১৯ অংশে রেকর্ড করা হয়েছে। 

২০২৩ সালে রেকর্ড মাত্রার উত্তপ্ত আবহাওয়ার কারনে চীন থেকে ইউরোপে মারাত্মক তাপপ্রবাহকে বাড়িয়ে তুলেছিল, চরম বৃষ্টির ফলে লিবিয়ায় হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল এবং কানাডার রেকর্ডে সবচেয়ে খারাপ দাবানলের মরসুম হয়েছিল।

বাংলাদেশে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব 

বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত এবং বসন্ত। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে আমাদের ঋতুতেও অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যেমন সঠিক সময়ে সঠিক ঋতুর আগমন ঘটছে না। গরমের সময় অতিরিক্ত গরম আর শীতের সময় অতিরিক্ত ঠান্ডা যা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে এছাড়াও কৃষি ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি।

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বন্যার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে বিগত বিগত বছরের তুলনায় অনেক গুণ এতে ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে । বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে তাতে বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল যেমন চট্টগ্রাম কক্সবাজার ডুবে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে ইতোমধ্যে ধারণা করা হচ্ছে আগামী দিনে এভাবে চলতে থাকলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ অদৃশ্য হয়ে যাবে।

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রতিকার 

বর্তমান সময়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন এত প্রকট আকার ধারণ করেছে যে এর প্রতিকার এখন সময়ের দাবি। বিশ্ব উষ্ণায়নের ভয়াবহতার ব্যাপারে ১৯৬৫ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পায়। এর প্রতিকারে আমরা নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ নিতে পারি,

১. জ্বালানি দহন কমিয়ে।
২. পেট্রোলিয়ামের অপচয় রোধ করে
৩. নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন কমিয়ে
৪. অপ্রচলিত শক্তি জৈব সারের ব্যবহার বাড়িয়ে
৫. খোলা ময়দানের প্লাস্টিক পলিব্যাগ না পোড়ানো
৬. শিল্প কারখানার বর্জ্য সঠিক নিয়ম মেনে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা

শেষ কথা 

বিশ্ব উষ্ণায়ন বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য এখন হুমকি। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য পরিণতি রোধ করা যেমন বাংলাদেশের জন্য জরুরি তেমনি প্রত্যেকটি দেশের জন্যও অত্যন্ত জরুরি বিষয়। এই বিশ্ব উষ্ণায়ণের প্রভাব ঠেকাতে ইতমধ্যে অনেক দেশ কাজ শুরু করে দিয়েছে।

বাংলাদেশেরও উচিত নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসা। প্রিয় পাঠক আশা করি আজকের এই পোস্টটি আপনার জন্য অনেক গুরুত্ব বহন করে। আরো নতুন কোন তথ্য পেতে আমার ওয়েবসাইটটি ফলো করুন, ধন্যবাদ। আরও জানতে কমেন্ট করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url