রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি কিভাবে ব্যবহার করা হবে

বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে আগ্রহ আমাদের অনেকের মধ্যে অনেকদিন ধরেই। মুল আগ্রহের বিষয় এ  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি কিভাবে ব্যবহার করা হবে। আজকের আলোচনায় এ বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে পুরো পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। 

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি কিভাবে ব্যবহার করা হবে

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের দেশের জন্য গর্বের। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে যে জ্বালানি ব্যবহার করা হবে সে সম্পর্কে আমাদের জানা জরুরী। আজকের আলোচনায়  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি কিভাবে ব্যবহার করা হবে তা বলা হবে চলুন দেরি না করে মুল আলোচনায় চলে যায়। 

ভূমিকা

বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায় অবস্থিত  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন হচ্ছে বিদেশি এবং দেশি ইঞ্জিয়ারদের মিলিত প্রচেষ্টায়। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৬১ সালে কিন্তু পড়ে তা বিভিন্ন কারনে বাতিল হয়ে যায়। 

পড়ে ২০০৯ সালে এ প্রজেক্ট বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। আজকের আলোচনায় পারমাণবিক জ্বালানি কি, বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ইতিহাস, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি কিভাবে ব্যবহার করা হবে এসব বিষয়ে আলোচনা করা হবে। 

পারমাণবিক জ্বালানি কি

পারমাণবিক জ্বালানি একটি বিশেষ ধরণের জ্বালানি। এটি মূলত পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি প্রধানত ইউরেনিয়াম-২৩৫ এবং প্লুটোনিয়াম- ২৩৯ এর মত ভারী মৌলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত যা পারমাণবিক চুল্লিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান উৎস ইউরেনিয়াম এবং প্লুটোনিয়াম। 

এর শক্তি উৎপাদন করা হয় নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ায় ভারী পরমাণুর বিভাজন ঘটিয়ে। এ জ্বালানি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, সাবমেরিন এবং মহাকাশযানে ব্যবহার করা হয়। প্রচলিত জালানির তুলনায় শক্তি উৎপাদন বেশি করে কিন্তু তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি করে যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়াও,

  • পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার এর জন্য উচ্চ নিরাপত্তা এবং সতর্কতার প্রয়োজন নয়ত মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
  • এর তেজস্ক্রিয় বর্জ্য দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন।
  • স্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বহুল হলেও দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক।
  • পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা জনসাধারণের জন্য এ ব্যবস্থা নিরাপত্তা ও সাস্থঝুকি আনতে পারে।

বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ইতিহাস

বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ইতিহাস একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফলাফল। এ  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি কিভাবে ব্যবহার করা হবে এটা জানার আগে আমাদের প্রকল্পের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। 

আরও পড়ুনঃ ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকছে রাসেল ভাইপার সাপ

এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রথম ধারণা করা হয়েছিল ১৯৬১ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পারমাণবিক শক্তি ব্যাবহারে পরিকল্পনার মাধ্যমে। এরপর ১৯৬৩ সালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে রূপপুরের স্থানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমি নির্ধারণ করা হয়। 

মূলত এ প্রকল্পটি ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানের সরকারের উদ্যোগে শুরু হয় কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেন। পড়ে আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলোর সহায়তা নিয়ে ১৯৮০ এর দশকে পুনরায় উদ্যোগ নেওয়া হয়। 

১৯৮৬ সালে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা(IAEA) সম্ভাব্য সমীক্ষা করেন। ১৯৯০ এর দশকে প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা করা হয় কিন্তু কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অতঃপর ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সরকার  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার সাথে চুক্তি সাক্ষর করে। 

২০১১ সালে  রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত রোসাটামের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হয়। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অক্টোবরে এ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং ২০১৫ সালে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রকল্পের মুল নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এর পর ধাপে ধাপে সব কাজ হয় তা হল,

  • ২০১৮ সালে প্রথম ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লির স্থাপনের কাজ শুরু হয়।
  • একই সালে প্রকল্পের প্রধান কংক্রিট ঢালাই সম্পন্ন হয়।
  • প্রকল্পের অর্থায়ন হিসেবে ১২.৬৫ বিলিয়ন রাশিয়ান ঋণ এবং সহায়তা হিসেবে সংরক্ষিত হয়।
  • ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়।
  • ২০২৪ সালের মধ্যে প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
  • এই প্রকল্পটি চালু হলে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে যা দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ হবে।
  • বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশে উন্নত অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি কিভাবে ব্যবহার করা হবে

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি ব্যাবহারের প্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং প্রযুক্তিগত। এর ব্যবহার কয়েকটি ধাপে করা হবে নিচে এর ধাপগুলো দেওয়া হল,

জ্বালানি প্রস্তুতি

  • রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ প্রয়োজন যা সরাসরি রাশিয়া থেকে আমদানি করা হবে।
  • ইউরেনিয়ামকে ফুয়েল রড বা ফুয়েল পিনে রুপান্তর করা হয় যা ফুয়েল অ্যাসেম্বলি গঠন করে।

নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে জ্বালানির ইনসার্ট

  • ফুয়েল অ্যাসেম্বলিগুলি রিঅ্যাক্টর কোরে প্রবেশ করানো হয় যা নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রস্থল।
  • ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর নিউক্লিয়াস নিউট্রন দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয় ফলে এটি বিভক্ত হয়ে প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন করে।

তাপ উৎপাদন এবং স্থানান্তর

  • ফিশন প্রক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন তাপকে রিঅ্যাক্টর কোরের ভিতর থেকে প্রাথমিক কুলান্টের মাধ্যমে একটি তাপ এক্সচেঞ্জারে স্থানান্তরিত করা হয়।
  • এই কুলান্ট সাধারণত উচ্চ চাপযুক্তপানি যা তাপকে নিরাপদভাবে বহন করে।

তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন

  • তাপ এক্সচেঞ্জারটি প্রাথমিক কুলান্টের তাপ ব্যবহার করে পানিকে বাষ্পে রুপান্তরিত করে।
  • বাষ্পটি টারবাইন ব্লেডগুলিকে ঘুরিয়ে দেয় যার ফলে যান্ত্রিক শক্তি উৎপন্ন হয়।

বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ

  • টারবাইনের সঙ্গে সংযুক্ত জেনারেটর যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রুপান্তরিত করে।
  • উৎপাদিত বিদ্যুতটি  রূপপুর থেকে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে সারা দেশে বিতরণ করা হয়।

ব্যবহ্রত জ্বালানির ব্যবস্থাপনা

  • ব্যবহার শেষে ফুয়েল রডগুলি রিঅ্যাক্টর থেকে সরিয়ে স্টোরেজ পুলে রাখা হয়।
  • স্টোরেজ পুলে পানির নিচে এসব রড রাখা হয় যাতে তারা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হতে পারে এবং রেডিওঅ্যাক্টিভিটি হ্রাস পায়।
  • স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ফিশন প্রতিক্রিয়া এবং রিঅ্যাক্টরের অপারেশন নিয়ন্ত্রণ করে।
  • বিভিন্ন সুরক্ষা ব্যবস্থা রিঅ্যাক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সহায়ক হয়।

লেখকের মন্তব্য

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই প্রকল্পটি আমদের দেশকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে যা শিল্প, ব্যবসা এবং সাধারণ মানুষের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। 

এছাড়াও এ প্রকল্পটি বাংলাদেশকে টেকসই এবং পরিবেশ-বান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে সহায়তা করবে। সার্বিকভাবে রূপপুর  পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url