পুরুষের হার্নিয়া রোগ কেন হয়, হার্নিয়া রোগের লক্ষণ এবং চিকিৎসা
পুরুষের হার্নিয়া রোগ কেন হয় এবং হার্নিয়া রোগের লক্ষণ এবং চিকিৎসা সম্বন্ধে আপনাদের অনেকেরই জানার আগ্রহ আছে। আজকের পোস্টে এ নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পুরো পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
আমাদের দেশে নারী এবং পুরুষ উভয়ের মধ্যেই হার্নিয়া রোগ দেখা যায় তবে পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায় তাই পুরুষের হার্নিয়া রোগ কেন হয় এবং হার্নিয়া রোগের লক্ষণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে দ্রুত মূল আলোচনায় চলে যান।
ভূমিকা
হার্নিয়া রোগটি আসলে কি
হার্নিয়া হল একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে শরীরের একটা অঙ্গ বা টিস্যু তার স্বাভাবিক স্থান থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। সাধারণত হার্নিয়া তখন ঘটে যখন শরীরের একটি অঙ্গ বা টিস্যু তার স্বাভাবিক অবস্থানে থাকা পেশীর দুর্বল অংশ বা একটি ফাঁকের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসে। এই অবস্থা সাধারণত পেটের এলাকায় ঘটে থাকে কিন্তু শরীরের অন্যান্য অংশেও হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ
মনোযোগ ঘাটতি বা হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD) এর লক্ষণসমূহ এবং চিকিৎসা।
ডেঙ্গু সৃষ্টিকারী এডিস মশার হাত থেকে বাঁচতে ১০টি কার্যকরী উপায়সমূহ।
তীব্র তাপদাহে অসহ্য গরমে নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় করণীয়সমূহ।
পুরুষদের মধ্যে যৌন অক্ষমতার কারনসমূহ এবং এর চিকিৎসা পদ্ধতি।
নিজেকে সুস্থ রাখার ১৬টি সহজ উপায়।
অ্যাজিথ্রোমাইসিন (Azithromycin) ব্যবহারের নিয়ম, এর ক্ষতিকর প্রভাব সমূহ এবং সতর্কতা।
হার্নিয়ার ধরনগুলো
ইনগুইনাল হার্নিয়াঃ পেটের নিম্ন অংশের পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পেটের একটি অংশ বা অন্ত্রের অংশ সেই ফাঁকের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে। পুরুষদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।
ফেমোরাল হার্নিয়াঃ এ ধরণের হার্নিয়া প্রধানত মহিলাদের মধ্যে ঘটে এবং এটি কুঁচকির নিচের অংশে ঘটে যেখানে একটি ফাঁকি দিয়ে অন্ত্রের একটি অংশ বেরিয়ে আসে।
ইউম্বিলিকাল হার্নিয়াঃ নাভির চারপাশে এই ধরণের হার্নিয়া ঘটে। এটি সাধারণত শিশুদের মধ্যে ঘটে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদেরও হতে পারে।
ইনসিশনাল হার্নিয়াঃ আগের অপারেশনের পরে যে পেশী বা টিস্যু দুর্বল হয়ে পড়ে সেখানে এই ধরণের হার্নিয়া ঘটে।
হাইয়েটাল হার্নিয়াঃ এটি পেটের একটি অংশ যা ডায়াফ্রাম অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশীর মাধ্যমে বুকে ঢুকে যায়।
হার্নিয়া রোগ কি কারনে হয়
পেশীর দুর্বলতা ও স্ট্রেন(Strain)
- জন্মগত বা অস্বাভাবিকভাবে পেশী দুর্বল হলে হার্নিয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
- ভারী বস্তু তুলতে গিয়ে পেশীর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে বা দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড কাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য বা প্রস্রাবে সমস্যা থাকলে পেশীর উপর স্ট্রেন তৈরি হয় যা হার্নিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
জন্মগত সমস্যা
অতিরিক্ত ওজন ও স্থুলতা
অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম
প্রসবকালীন সমস্যা
সার্জারি
বৃদ্ধ বয়স
কোন কোন লক্ষণ দেখলে সতর্ক হবেন
হার্নিয়া রোগের লক্ষণগুলি হার্নিয়ার ধরণ ও অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণত কিছু প্রধান লক্ষণ আছে যা বেশিরভাগ হার্নিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়। নিচে এর লক্ষণগুলো সম্পর্কে বিবরণ করা হল,
স্ফীতি ও ফোলাভাব
- আক্রান্ত স্থানে একটি স্ফীত ও ফোলা অংশ দেখা যায় যা সাধারণত চামড়ার নিচে বোঝা যায়।
- স্ফীত জায়গাটি সাধারণত শারীরিক কার্যকলাপ, কাশি বা ভারী বস্তু উত্তোলনের পরে স্পষ্ট হয় এবং বিশ্রাম বা শোবার সময় কমে যেতে পারে।
ব্যথা বা অস্বস্তি
- আক্রান্ত স্থানে বা তার আশেপাশে চাপ বা টান অনুভূত হতে পারে।
- শারীরিক কার্যকলাপ, হাঁটা বা সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় ব্যথা বা অস্বস্তি বাড়তে পারে।
- কখনও কখনও হালকা থেকে তীব্র ব্যথা হতে পারে বিশেষত যদি হার্নিয়া আটকিয়ে যায়।
জ্বলন বা টান অনুভূতি
- স্ফীত জায়গায় জ্বলন, টান বা ভারী অনুভূত হতে পারে।
- বিশেষ করে কাশি বা প্রচণ্ড শ্বাস নেওয়ার সময় এই অনুভূতি হতে পারে।
মলত্যাগ বা প্রস্রাবের সমস্যা
- বিশেষ করে ইনগুইনাল বা ফেমোরাল হার্নিয়া হলে মলত্যাগ বা প্রস্রাবের সমস্যা হতে পারে।
- কখনও কখনও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
বমি বা বমি বমি ভাব
- বিশেষ করে যদি হার্নিয়া আটকে যায় তখন বমি বা বমি বমি ভাব হতে পারে।
- এটি একটি গুরুতর লক্ষণ এবং দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
বিশেষ ধরণের হার্নিয়ার লক্ষ্মণসমূহ
ইনগুইনাল হার্নিয়া
- কুঁচকির একপাশে বা উভয় পাশে ফোলা অংশ দেখা যায়।
- কুঁচকির কাছে ব্যথা, বিশেষ করে যখন কাশি, বাঁকানো বা ভারী বস্তু তোলার চেষ্টা করা হয়।
- পুরুষদের ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ স্ফীত হতে পারে যা নিচে ভারী অনুভূতি হতে পারে।
ফেমোরাল হার্নিয়া
- সাধারণত উরুর উপরের অংশ বা কুঁচকির নিচে ছোট একটি ফোলা অংশ দেখা যায়।
- হাঁটার সময় বা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলে ব্যথা অনুভূত হবে।
আম্বিলিকাল হার্নিয়া
- নাভির কাছে একটি ছোট স্ফীত দেখা যায় যা চাপ দিলে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে।
- বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খাওয়ার পরে বা কান্নার সময় ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
হাইয়েটাল হার্নিয়া
- বুকের মধ্যে বা পেটে জ্বালা অনুভূত হয় যা সাধারণত গ্যাসট্রোইফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ হিসেবে পরিচিত।
- গিলতে কষ্ট হতে পারে বা খাদ্য গলায় আটকে থাকার অনুভূতি হতে পারে।
- এই ধরণের হার্নিয়ায় ঢেকুর বেশি আসতে পারে এবং বুকের মধ্যে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
পুরুষের হার্নিয়া রোগ কেন হয়
পুরুষদের মধ্যে হার্নিয়া রোগ বেশি দেখা যায় কারন পুরুষদের ইনগুইনাল অঞ্চলে দুর্বলতা থাকে। এছাড়াও উপরোক্ত লক্ষ্মণসমূহ পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যাওয়ার কারনে পুরুষদের হার্নিয়া রোগ হয়।
হার্নিয়া রোগের চিকিৎসা
হার্নিয়া চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য হল সমস্যা দূর করা, ব্যথা কমানো এবং ভবিষ্যৎ কোন জটিলতা এড়ানো। হার্নিয়ার চিকিৎসা মূলত নির্ভর করে হার্নিয়ার ধরণ, আকার, অবস্থান এবং উপসর্গের গুরুতরতার উপর। চিকিৎসা প্রধানত তিনটি প্রধান পদ্ধতিতে বিভক্ত নিচে তা আলোচনা করা হল,
সারজিক্যাল চিকিৎসা
হার্নিয়া সরানোর সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হল সার্জারি। এটি দুটি প্রধান প্রকারে বিভক্তঃ
খোলা সার্জারি
খোলা সার্জারিতে সার্জন হার্নিয়ার স্থানে একটি বড় চেরা কেটে হার্নিয়াটি পুনরায় স্থানান্তর করে এবং দুর্বল অংশটি শক্তিশালী করে।এটি দুই ভাবে হয়,
- হার্নিয়ার জায়গা সেলাই করে ঠিক করা হয় একে বলে হার্নিয়োরাফি।
- একটি সিনথেটিক মেশ বা টিস্যু দিয়ে দুর্বল অংশটি ঢেকে শক্তিশালী করা হয় একে বলে হার্নিওপ্লাস্টিক বলে।
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে ছোট ছোট কাটা স্থান ব্যবহার করে পেটের মধ্যে একটি ক্যামেরা প্রবেশ করানো হয়। সার্জন ক্যামেরার মাধ্যমে হার্নিয়া সরাতে ছোট যন্ত্র ব্যবহার করেন।
ছোট থেকে মাঝারি আকারের হার্নিয়া, সক্রিয় জীবনযাত্রা রয়েছে এমন রোগী এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার প্রয়োজন এমন রোগীর ক্ষেত্রে এ সার্জারি করা হয়।
লাইফস্টাইল পরিবর্তন
কিছু ক্ষেত্রে সার্জারি ছাড়াও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করা যায় বিশেষত যখন হার্নিয়ার আকার ছোট এবং তীব্র উপসর্গ নেই।
আরও পড়ুনঃ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ।
ওজন নিয়ন্ত্রণঃ অতিরিক্ত ওজন শরীরের পেটের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে যা হার্নিয়া বাড়াতে পারে। ওজন কমানোর মাধ্যমে এই চাপ কমানো সম্ভব।
ভারী ওজন তোলা এড়িয়ে চলাঃ ভারী ওজন তোলা হার্নিয়া বাড়াতে পারে। সঠিক ওজন উত্তোলনের কৌশল এবং সাপোর্ট ব্যবহার করা উচিত।
ডায়েট পরিবর্তনঃ কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পেটের চাপ কমানোর জন্য ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত।
অতিমাত্রায় কাশি বা চিৎকার এড়িয়ে চলাঃ কাশি বা চিৎকারে পেটের উপর চাপ বাড়তে পারে যা হার্নিয়া বাড়াতে পারে।
কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট
যারা সার্জারি করতে চান না বা সার্জারির ঝুঁকি বেশি তাদের জন্য কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট উপযুক্ত হতে পারে। এতে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারী বিভিন্ন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্তঃ
হার্নিয়া বেল্ট বা ট্রাসঃ হার্নিয়া বেল্ট বা ট্রাস ব্যবহার করা যেতে পারে যা হার্নিয়া অবস্থানকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে এবং ব্যথা কমায়।
প্রতিরোধমূলক ঔষধঃ ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে ব্যথানাশক ও প্রদাহবিরোধী ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
হার্নিয়ার জটিলতা ও সতর্কতা
হার্নিয়া যদি অপারেশন করা না হয় তবে এটি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যেমনঃ
স্ট্রেংগুলেটেড হার্নিয়াঃ হার্নিয়ার মাধ্যমে বেরিয়ে আসা টিস্যু বা অঙ্গের রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেলে এটি একটি জরুরি অবস্থা হতে পারে।
অবস্ট্রাক্টেড হার্নিয়াঃ অন্ত্রের একটি অংশ হার্নিয়া স্যাকের মধ্যে আটকে গেলে পেটের চলাচল ব্যাহত হতে পারে।
লেখকের মন্তব্য
হার্নিয়া একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যেখানে অভ্যন্তরীণ অঙ্গ পেশীর একটি দুর্বল অংশ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এ থেকে বাঁচতে আমাদের উপরোক্ত আলোচনা অনুযায়ী চলতে হবে তাহলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url