বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব

 বাংলাদেশের মারমা সম্প্রদায় সম্পর্কে আমাদের অনেকের জানার কৌতূহল আছে। আজকের আলোচ্য পোস্টে বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যা আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রশ্ন আসে এটা নিয়ে। তাই এ বিষয়ে জানতে পুরো পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।

বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব

বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব  আমাদের সংস্কৃতির একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদেরকে নিয়ে আমাদের গর্ব করা উচিত। তার আগে তাদের সম্বন্ধে জানতে দ্রুত মূল আলোচনায় চলে যায়। 

ভূমিকা 

মারমা সম্প্রদায় বাংলাদেশের অন্যতম শান্তিপ্রিয় ও সংস্কৃতিমুখী জনগোষ্ঠী। তাদের আন্তরিকতা, অতিথিপরায়ণতা এবং সামাজিক বন্ধনের দৃঢ়তা তাদের জীবনধারায় প্রতিফলিত হয়। মারমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা বিভিন্ন নৃত্য, গান এবং উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশিত দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে। 

এই সম্প্রদায় কৃষিকাজ, বুননশিল্প এবং হস্তশিল্পে পারদর্শী যা তাদের স্বনির্ভরশীলতা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রমাণ। মারমা জনগোষ্ঠী তাদের ঐতিহ্যবাহী এবং সমন্বিত জীবনধারা রক্ষার মাধ্যমে আমাদের সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। আজকে এই মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য, মারমা সম্প্রদায়ের ভাষা, মারমা খাবার, মারমাদের বাড়ি, মারমা মেয়েদের পোশাক এবং মারমাদের উৎসব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ

স্মার্ট কার্ড স্ট্যাটাস চেক অনলাইন এবং এনআইডি(NID) স্মার্ট কার্ড ডাউনলোড।

২০২৪ সালে যাদের আসতে হবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে।

২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের বাংলাদেশের বাজেটে যেসবের দাম বাড়ছে যেসবের কমছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি কিভাবে ব্যবহার করা হবে।

ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকছে রাসেল ভাইপার সাপ।

২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের ইনকাম ট্যাক্স দেওয়ার নিয়ম কানুন এবং আয়কর আইন বা জরিমানা।

মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য

মারমা সম্প্রদায় বাংলাদেশের একটি আদিবাসী গোষ্ঠী। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষ করে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে তাদের প্রধান বসবাস। মারমা সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, সামাজিক কাঠামো, এবং ধর্মীয় রীতিনীতি বিভিন্ন দিক থেকে সমৃদ্ধ। নিচে মারমা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো

ইতিহাস ও উৎপত্তি

মারমা সম্প্রদায়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে তারা মূলত মিয়ানমারের আরাকান (বর্তমানে রাখাইন) থেকে এসেছে। মারমা শব্দটি "ম্রো" বা "ম্রো-আং" থেকে উদ্ভূত  যার অর্থ হল ‘পাহাড়ি লোক’। তারা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে আসে এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

ধর্ম ও বিশ্বাস

মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্ম হল বৌদ্ধধর্ম। তারা মূলত থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম পালন করে। এছাড়া তারা তাদের নিজস্ব কিছু লোকজ বিশ্বাস ও প্রথা পালন করে থাকে যা মূলত প্রকৃতিপূজার সাথে সম্পর্কিত।

সংস্কৃতি ও জীবনধারা

সংগীত ও নৃত্য: মারমারা তাদের সংস্কৃতিতে সংগীত ও নৃত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে মারমা নৃত্য এবং সংগীতের আয়োজন হয়।

পোশাক: মারমারা সাধারণত রঙিন ও আকর্ষণীয় পোশাক পরিধান করে। পুরুষেরা লুঙ্গি ও জামা পরিধান করে আর নারীরা পাথিন বা লঙ্গি নামে পরিচিত এক ধরনের স্কার্ট ও ব্লাউজ পরে।

উৎসব: মারমারা প্রধানত “সংগ্রাইন” নামে পরিচিত নববর্ষ উৎসব পালন করে যা থাই ও লাওসের "সঙক্রান" উৎসবের সমতুল্য। এছাড়া বৌদ্ধ ধর্মীয় বিভিন্ন উৎসবও তারা পালন করে।

খাদ্যাভ্যাস

মারমা সম্প্রদায় মূলত কৃষিজীবী এবং তাদের খাদ্যাভ্যাসে ধান, ভুট্টা, শাকসবজি এবং মাংসের বিভিন্ন প্রকার অন্তর্ভুক্ত। তারা “বাঁশ কাঁচি” এবং “মাছের পাতুরি” নামের কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করে।

আবাসন ও স্থাপত্য

মারমারা সাধারণত পাহাড়ের ঢালে বা উপত্যকায় বসবাস করে। তাদের বাড়ি বাঁশ, কাঠ এবং পাতা দিয়ে তৈরি হয় যা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এসব ঘর সাধারণত মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে তোলা হয় যা ভূমিকম্প বা বন্যার সময় ঘরকে রক্ষা করে।

সামাজিক কাঠামো

মারমা সম্প্রদায়ের সামাজিক কাঠামো সাধারণত পিতৃতান্ত্রিক। সমাজের নেতৃত্ব সাধারণত পুরুষেরা পালন করে। তবে নারীরাও তাদের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিশেষ করে পরিবারের অর্থনৈতিক কাজকর্মে।

শিক্ষা ও অর্থনীতি 

শিক্ষা: মারমা সম্প্রদায়ে শিক্ষার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান সময়ে অনেক মারমা শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে এবং উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে।

অর্থনীতি: মারমারা মূলত কৃষি, মৎস্য এবং ছোটখাট ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা পর্যটন শিল্পেও যুক্ত রয়েছ কারণ চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাদের অনেক আয় এনে দেয়।

প্রতিদিনের জীবন

মারমা সম্প্রদায়ের প্রতিদিনের জীবনে কঠোর পরিশ্রমের ছাপ স্পষ্ট। তারা সাধারণত ভোরে উঠে দিনের কাজ শুরু করে এবং সূর্যাস্তের পর বিশ্রামে চলে যায়। তাদের জীবনযাত্রা প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রেখে চলে।

মারমা সম্প্রদায়ের এই সব বৈশিষ্ট্য তাদেরকে অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে আলাদা করে। তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং জীবনধারা বাংলাদেশের আদিবাসী সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

মারমা সম্প্রদায়ের ভাষা

বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব এর মধ্যে মারমা সম্প্রদায়ের ভাষা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভাষাটি মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি শক্তিশালী সেতু হিসেবে কাজ করে যা তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সামাজিক জীবনকে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে। নিচে মারমা ভাষার বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো,

ভাষার পরিচিতি  

মারমা ভাষা তিব্বতি-বর্মী ভাষা পরিবারের অন্তর্গত এবং এটি মিয়ানমারের বর্মী ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এটি মূলত চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের মারমা জনগণের মাতৃভাষা।

ভাষার উৎস ও ইতিহাস

মারমা ভাষার মূল উৎস মিয়ানমার। মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে এসেছিল এবং তারা তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি সাথে নিয়ে এসেছিল। বর্তমানে মারমারা তাদের ভাষা মূলত মৌখিকভাবে সংরক্ষণ করে রেখেছে।

বর্ণমালা ও লেখনী 

মারমা ভাষার নিজস্ব কোন প্রাচীন লিপি নেই। তবে তারা বর্মী লিপি ব্যবহার করে তাদের ভাষা লিখিত আকারে প্রকাশ করে। বর্মী বর্ণমালার ৩৩টি স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ আছে যা মারমা ভাষার জন্যও প্রযোজ্য। মারমারা বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে তাদের ভাষার কিছু লিখিত ফর্ম তৈরি করেছে যা স্থানীয় শিক্ষা এবং সরকারি কাজে ব্যবহার করা হয়।

ভাষার উপভাষা

মারমা ভাষার বিভিন্ন উপভাষা বা উপভাষী বৈচিত্র্য রয়েছে যা অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের মারমা জনগণের মধ্যে ভাষার উচ্চারণ, শব্দের গঠন এবং বাক্য গঠনে কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে।

ভাষার শব্দভাণ্ডার

মারমা ভাষার শব্দভাণ্ডার বিভিন্ন ধরণের শব্দের সমৃদ্ধ। এটি প্রধানত বর্মী ভাষা থেকে উদ্ভূত হলেও এতে বাংলা এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাবও রয়েছে। ভাষার শব্দগুলো প্রধানত কৃষি, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতিনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত।

ভাষার ব্যবহার

পারিবারিক ও সামাজিক জীবন: মারমা ভাষা তাদের দৈনন্দিন পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তারা পরিবার এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ভাষা ব্যবহার করে।

শিক্ষা: মারমা ভাষায় প্রাথমিক স্তরের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে শিশুদের তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। উচ্চ শিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীরা বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা গ্রহণ করে।

ধর্মীয় আচার: মারমা সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় আচার ও উৎসবে মারমা ভাষার ব্যবহার করে। তাদের প্রার্থনা, ধর্মীয় গান এবং উৎসবের সঙ্গীত এই ভাষায় পরিচালিত হয়।

ভাষার বর্তমান অবস্থা

মারমা ভাষার বর্তমান অবস্থা কিছুটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যারা শহরে বসবাস করে এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সাথে বেশি পরিচিত। তবে মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের ভাষার সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চলছে। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন মারমা ভাষার পাঠদান ও প্রচারে জড়িত।

ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ

মারমা ভাষার সংরক্ষণে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে

শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম: প্রাথমিক শিক্ষায় মারমা ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে।

সাংস্কৃতিক সংগঠন: সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মারমা ভাষার প্রচারে কাজ করছে।

বই ও প্রকাশনা: মারমা ভাষায় বিভিন্ন বই ও পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে যা ভাষার সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ভাষার ভবিষ্যৎ

মারমা ভাষার ভবিষ্যৎ সংরক্ষণে অনেক নির্ভর করছে তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টা এবং সরকারের সমর্থনের উপর। ভাষার প্রচার, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের মাধ্যমে মারমা ভাষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সংরক্ষিত থাকবে বলে আশা করা যায়।

মারমা ভাষার এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তাদের সমাজের বিভিন্ন দিককে সমৃদ্ধ করে।

মারমা খাবার

মারমা সম্প্রদায় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রধান আদিবাসী গোষ্ঠী। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে খাবারেও রয়েছে বিশেষত্ব ও বৈচিত্র্য। মারমা খাবারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল প্রাকৃতিক ও তাজা উপকরণের ব্যবহার এবং সহজ প্রক্রিয়ায় রান্না। এখানে তাদের কিছু প্রধান ও পরিচিত খাবারের বর্ণনা দেয়া হল,

চিং (Ching)

চিং একটি জনপ্রিয় মারমা খাবার যা সাধারণত বাঁশের ভেতরে রান্না করা হয়। এতে বিভিন্ন সবজি, মাংস, এবং মসলা ব্যবহার করা হয়। বাঁশের ভেতরে রান্না হওয়ায় খাবারে একটি বিশেষ সুগন্ধ আসে।

পাইংসা (Paingsa)

পাইংসা হলো মাছের তৈরি একটি বিশেষ পদ যা বাঁশের ভেতরে রান্না করা হয়। এই খাবারটি ভাপিয়ে বা অল্প তাপে ধীরে ধীরে রান্না করা হয়। এতে মাছের প্রকৃত স্বাদ বজায় থাকে এবং এতে খুব কম মসলা ব্যবহার করা হয়।

পাজু (Paju)

পাজু হলো পান্তাভাতের মতো একটি খাবার যা সাধারণত সকালে বা দুপুরের খাবারে খাওয়া হয়। এটি মূলত ভাতের সাথে কিছু প্রাকৃতিক উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হয় যেমন, শাকসবজি, কাঁচা মরিচ, এবং লেবু।

জুম চালের ভাত (Jum Rice)

জুম চাল হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎপাদিত বিশেষ ধরণের চাল। এই চালের ভাত মারমা সম্প্রদায়ের খাদ্য তালিকায় একটি প্রধান অংশ। জুম চালের ভাত খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর।

সুপা (Supa)

সুপা হলো মারমা সম্প্রদায়ের একটি জনপ্রিয় স্যুপ। এটি সাধারণত সবজি, মাংস বা মাছ দিয়ে তৈরি করা হয় এবং এতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক মসলা যোগ করা হয়। সুপা সহজপাচ্য এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

লেপা পোড়া (Lepa Pora)

লেপা পোড়া হলো বিশেষভাবে রান্না করা শুকরের মাংস। এটি সাধারণত খোলা আগুনে বা গ্রিল করে রান্না করা হয় এবং এতে প্রাকৃতিক মসলা এবং তাজা লেবুর রস ব্যবহার করা হয়।

জুম মরিচের আচার (Jum Chili Pickle)

এই আচারটি জুম মরিচ এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি সাধারণত তীব্র এবং মসলাদার স্বাদের হয় যা মারমা খাবারের সাথে খাওয়ার জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়।

রান্নার পদ্ধতি ও খাদ্যপ্রণালী

মারমা সম্প্রদায়ের রান্নার পদ্ধতি সাধারণত খুব সহজ ও স্বাস্থ্যকর। তারা তাদের খাবারে সাধারণত প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করেন এবং মসলার ব্যবহারও কম। তাজা সবজি, মাছ এবং মাংস তাদের খাদ্যের প্রধান উপাদান। বাঁশের ভেতরে রান্না করা এবং খোলা আগুনে খাবার গ্রিল করা তাদের রান্নার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

মারমাদের বাড়ি

মারমা সম্প্রদায় বাংলাদেশের একটি আদিবাসী গোষ্ঠী যারা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি এবং সামাজিক আচার-আচরণ বেশ সমৃদ্ধ। মারমা সম্প্রদায়ের বাড়ি বা বাসস্থান তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিচে মারমা সম্প্রদায়ের বাড়ি নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো, 

বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব

মারমা সম্প্রদায়ের বাড়ির বৈশিষ্ট্যঃ

স্থাপত্যের ধরন

উপকরণ: মারমা সম্প্রদায়ের বাড়ি সাধারণত বাঁশ, কাঠ, কাঁচা ইট এবং কাদামাটি দিয়ে তৈরি হয়। বাঁশ এবং কাঠের ব্যবহার খুবই প্রচলিত কারণ এগুলি সহজলভ্য এবং স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খায়।

উঠোনের অবস্থান: বাড়ির সামনে একটি বড় উঠোন থাকে যা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হয়।

গঠন ও নকশা

উচ্চতায় নির্মিত: মারমা সম্প্রদায়ের বাড়ি মাটির উপর উঁচু করে তৈরি হয়। এই উঁচু প্ল্যাটফর্মগুলো সাধারণত কাঠ বা বাঁশের স্তম্ভের উপর তৈরি হয় যা তাদেরকে বন্যা থেকে রক্ষা করে এবং ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহের সুযোগ দেয়।

ছাদ: তাদের ছাদগুলি ঢালু এবং বাঁশ বা খড় দিয়ে তৈরি হয় যা বৃষ্টির পানি সহজেই গড়িয়ে নামতে সহায়তা করে।

কক্ষ বিভাজন: ঘরের ভেতরে সাধারণত কয়েকটি কক্ষ থাকে যেমন শোবার ঘর, রান্নাঘর, এবং একটি মূল কক্ষ যেখানে তারা অতিথিদের স্বাগত জানায়।

আসবাবপত্র

মেঝে এবং বসার ব্যবস্থা: মেঝে সাধারণত কাঠের বা বাঁশের তক্তা দিয়ে তৈরি করা হয় এবং বসার জন্য মাদুর বা স্থানীয়ভাবে তৈরি আসন ব্যবহার করা হয়।

শোয়ার ব্যবস্থা: শোবার জন্য সাধারণত মাটিতে মাদুর পেতে বা কাঠের খাট ব্যবহৃত হয়।

সামাজিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান

ধর্মীয় অনুষ্ঠান: বাড়িতে মারমা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয় যেমন বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতি-নীতি।

সামাজিক অনুষ্ঠান: বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিবাহ, জন্মদিন এবং অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানও বাড়িতে আয়োজন করা হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আধুনিক উপকরণ এবং ডিজাইনের প্রভাব মারমা বাড়িগুলোর উপর পড়ছে। অনেকেই এখন পাকা ইট এবং কংক্রিটের ব্যবহার শুরু করেছেন, তবে তাদের ঐতিহ্যবাহী নকশা এবং স্থাপত্যের অনেক বৈশিষ্ট্য এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

মারমা সম্প্রদায়ের বাড়ি ও তাদের স্থাপত্য নিয়ে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় আনতে হবে যেমন তাদের স্থাপত্যের ঐতিহ্য, উপকরণের ব্যবহার, পরিবেশের সাথে সম্পর্ক এবং সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব। এখানে আরও বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা হলো,

স্থাপত্যের ঐতিহ্য

মারমা সম্প্রদায়ের স্থাপত্যে ঐতিহ্যবাহী উপকরণ এবং নকশার সংমিশ্রণ দেখা যায়। এই স্থাপত্যের মূল বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে

স্থানীয় উপকরণের ব্যবহার

বাঁশ: বাঁশ তাদের বাড়ির প্রধান উপকরণ। বাঁশের স্তম্ভ, মেঝে, দেয়াল এবং ছাদ গঠন করে। বাঁশ সহজলভ্য, হালকা এবং মজবুত হওয়ায় এটি আদর্শ নির্মাণ উপকরণ।

কাঠ: বাঁশের পাশাপাশি কাঠও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত মেঝে এবং স্তম্ভ তৈরিতে কাঠ ব্যবহার করা হয়।

কাদামাটি এবং খড়: দেয়ালের খাঁজ পূরণ এবং ছাদ তৈরিতে কাদামাটি এবং খড় ব্যবহৃত হয় যা প্রাকৃতিক তাপ নিরোধক হিসেবে কাজ করে।

নির্মাণের কৌশল  

মারমা সম্প্রদায়ের বাড়িগুলোর নির্মাণে বিশেষ কিছু কৌশল ব্যবহৃত হয় যা তাদের বাড়িগুলোকে টেকসই এবং আরামদায়ক করে তোলে

মাটি থেকে উঁচুতে নির্মাণ

বাড়িগুলি সাধারণত মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে প্ল্যাটফর্মের উপর তৈরি হয়। এর ফলে বন্যার ঝুঁকি কমে যায় এবং সর্প ও অন্যান্য বিপদজনক প্রাণী থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়।

মাটির স্তম্ভগুলি (যা "স্তম্ভ বাঁশ" নামে পরিচিত) ভারসাম্য বজায় রাখে এবং গঠনকে স্থিতিশীল করে।

ঢালু ছাদ

ঢালু ছাদগুলি বৃষ্টির পানি দ্রুত সরাতে সহায়তা করে। ছাদ সাধারণত বাঁশ বা খড় দিয়ে তৈরি করা হয় এবং কখনও কখনও টিনও ব্যবহৃত হয়।

ছাদের ঢালগুলি ঘরের ভেতরে বাতাস প্রবাহিত করতে সহায়তা করে যা ঘরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

বায়ু চলাচলের সুবিধা

ঘরের ভেতর ও বাইরের মধ্যে বায়ু চলাচলের জন্য বিভিন্ন খোলা জায়গা রাখা হয়। এর ফলে ঘরের ভেতরে বাতাস চলাচল করতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

ঘরের অভ্যন্তরীণ বিন্যাস

মারমা বাড়ির অভ্যন্তরীণ বিন্যাস খুবই কার্যকরী এবং তাদের সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানকে সমর্থন করে,

মূল কক্ষ 

পরিবারের প্রধান কক্ষ বা "সালামকান" সাধারণত ঘরের কেন্দ্রস্থলে থাকে। এটি পরিবারের সদস্যদের একত্রিত হওয়ার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য এই কক্ষটি গুরুত্বপূর্ণ।

শোবার কক্ষ

শোবার কক্ষগুলি সাধারণত পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কক্ষগুলো সাধারণত ছোট এবং মাদুর বা কাঠের খাটের ব্যবস্থা থাকে।

রান্নাঘর

রান্নাঘর বা "চুলা ঘর" ঘরের এক পাশে থাকে। এখানে বাঁশ বা কাঠের তৈরি স্টোভ ব্যবহৃত হয় এবং রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ রাখা হয়।

উঠোন 

বাড়ির সামনে একটি বড় উঠোন থাকে যা সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি পরিবারের জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সংস্কৃতি ও সমাজ

মারমা সম্প্রদায়ের বাড়িগুলো তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে কাজ করে

আতিথেয়তা

মারমা সম্প্রদায় অতিথিদের স্বাগত জানাতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তাদের বাড়িতে অতিথিদের স্বাগত জানানোর এবং খাবার পরিবেশন করার স্থানগুলি বিশেষভাবে সাজানো হয়।

পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান

বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যেমন বিবাহ, উৎসব, এবং পূজা অনুষ্ঠান বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয়।

তাদের ঘরের অবকাঠামো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে একসাথে অনেক লোকের সমাগম করা যায়।

আধ্যাত্মিক বিশ্বাস

মারমা সম্প্রদায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাদের ঘরে ধর্মীয় স্থাপনাও দেখা যায় যেমন বুদ্ধের মূর্তি এবং ধুপ জ্বালানোর স্থান।

আধুনিক পরিবর্তন

বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মারমা সম্প্রদায়ের বাড়িগুলোতে কিছু আধুনিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে

পাকা নির্মাণ

অনেক মারমা পরিবার এখন পাকা ইট এবং কংক্রিট ব্যবহার করে বাড়ি নির্মাণ করছেন। এর ফলে তাদের ঘরের স্থায়িত্ব এবং সুরক্ষা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আধুনিক সুবিধা

আধুনিক গৃহস্থালি সুবিধা যেমন বিদ্যুৎ, টেলিভিশন এবং টয়লেট ব্যবস্থা বাড়িতে যোগ করা হয়েছে।

সংস্কৃতির সংরক্ষণ

যদিও আধুনিক উপকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে তবে মারমা সম্প্রদায় তাদের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলি রক্ষা করার চেষ্টা করছেন।

মারমা মেয়েদের পোশাক

মারমা মেয়েদের পোশাক তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মারমা সম্প্রদায় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী একটি উপজাতি গোষ্ঠী এবং তাদের পোশাকও তাদের ঐতিহ্য ও জীবনধারার সাথে সম্পর্কিত। এখানে মারমা মেয়েদের পোশাক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো,

বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব

থামুং বা থবং (Thami or Thabong)

থামুং বা থবং হলো মারমা মেয়েদের প্রধান পোশাক যা একটি দীর্ঘ স্কার্টের মতো। এটি কোমর থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখে এবং সাধারণত মোটা কাপড়ের তৈরি। এটি হাতে বোনা এবং রঙিন নকশা ও আল্পনায় সমৃদ্ধ। সাধারণত এটি কোমরের চারপাশে পেঁচিয়ে পড়া হয় এবং বেল্ট বা কাঁথা দিয়ে আটকানো হয়।

আচিক বা আংকি (Achi or Anki)

আচিক বা আংকি হলো মারমা মেয়েদের উপরের পোশাক যা ব্লাউজ বা শার্টের মতো। এটি সাধারণত তুলার তৈরি এবং লম্বা হাতা থাকে। পোশাকটি সাধারণত সরল ও উজ্জ্বল রঙের হয়। এটি কোমরের উপরে পড়া হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে থামুংয়ের নিচে ঢেকে রাখা হয়।

খাবাং (Khadiang or Shawl)

খাবাং হলো একটি শাল বা চাদর যা ঠান্ডা আবহাওয়ায় ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত রঙিন এবং নকশা করা হয় যা তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য প্রকাশ করে। খাবাং সাধারণত কাঁধের ওপর পেঁচিয়ে রাখা হয়।

অলঙ্কার

মারমা মেয়েরা তাদের পোশাকের সাথে বিভিন্ন ধরনের অলঙ্কার পরিধান করে। এর মধ্যে রয়েছে

কানের দুল: রঙিন পাথর বা ধাতুর তৈরি।

হার: সাধারণত চেইন বা মুক্তার তৈরি।

হাতের বালা: রঙিন কাঁচের বালা বা ধাতুর বালা।

কিশোরী ও কিশোরীদের পোশাক

মারমা সম্প্রদায়ের কিশোর ও কিশোরীরা সাধারণত সরল এবং রঙিন পোশাক পড়ে। তাদের পোশাকে বড়দের পোশাকের তুলনায় কম অলঙ্কার থাকে তবে রঙ এবং ডিজাইনে বৈচিত্র্য থাকে।

উৎসবের পোশাক

উৎসব বা বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় মারমা মেয়েরা আরও জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিধান করে। এগুলো সাধারণত উজ্জ্বল রঙের এবং জটিল নকশায় পূর্ণ হয়। তারা এই সময়ে প্রচুর অলঙ্কার ও সাজসজ্জাও করে।

ব্যবহারিকতা

মারমা মেয়েদের পোশাক শুধুমাত্র সুন্দরই নয় এটি ব্যবহারিকও। পার্বত্য এলাকার ঠান্ডা আবহাওয়া এবং শারীরিক কাজের সাথে মানিয়ে নিতে তাদের পোশাক তৈরি করা হয়।

মারমা পরিবারের প্রধান কে 

মারমা জাতি বাংলাদেশের বৃহত্তম পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটি এবং চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় এদের বসবাস। বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব   সম্পর্কে জানতে হলে    তাদের পরিবারের প্রধান বা “গ্রাম প্রধান” কে তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। 

বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব

পরিবারের প্রধান বা কর্তা 

  • মারমা পরিবারে প্রধান ব্যক্তিকে সাধারণত "কর্তা" বলা হয়। কর্তাই পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেন এবং পরিবারের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি পরিচালনা করেন।

সামাজিক ভূমিকা

  • গ্রাম প্রধান: মারমা সমাজে গ্রামপ্রধান বা 'কার্বারি' (কিংবা 'কার্বারী') একজন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নেতা। তিনি গ্রামের প্রশাসনিক, বিচারিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন।
  • প্রধানের নির্বাচন: গ্রামপ্রধান সাধারণত বয়োজ্যেষ্ঠ বা প্রভাবশালী ব্যক্তি হন এবং গ্রামবাসীর সম্মতিক্রমে নির্বাচিত হন।

পরিবার ও সামাজিক কাঠামো

  • নিউক্লিয়ার পরিবার: মারমা পরিবারগুলি সাধারণত নিউক্লিয়ার পরিবার কাঠামোর অন্তর্গত যেখানে বাবা মা এবং তাদের সন্তানরা একসাথে বসবাস করে। পরিবারের প্রধান সাধারণত পিতা বা বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ হন।
  • প্রথাগত ভূমিকা: পরিবারের প্রধান পরিবারের সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সন্তানদের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য

  • সংস্কৃতি: মারমা সংস্কৃতিতে পরিবার এবং সমাজের মেলবন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের প্রধান বা গ্রামপ্রধান এই ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
  • ধর্মীয় উৎসব: মারমা পরিবারে ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসব পালনে পরিবারের প্রধানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

মারমা সমাজের প্রশাসনিক ব্যবস্থা

চিফ (রাজা)

  • বোমাং সার্কেল: মারমা সম্প্রদায়ের একটি অংশ চট্টগ্রাম এবং বান্দরবান এলাকায় "বোমাং সার্কেল" নামে পরিচিত। বোমাং সার্কেল চিফ যাকে সাধারণত "বোমাং রাজা" বলা হয় সমগ্র অঞ্চলের প্রশাসনিক প্রধান।
  • রাজ পরিবারের ইতিহাস: বোমাং রাজ পরিবারটির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে যা মারমা সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে।

চীফ প্রধানের দায়িত্ব

  • প্রশাসনিক দায়িত্ব: চীফ প্রধান হিসেবে বোমাং রাজা স্থানীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন।
  • আদালত ও বিচার: তিনি এলাকার বিভিন্ন বিবাদ ও সমস্যার সমাধান করেন এবং বিচারিক দায়িত্ব পালন করেন।

মারমা পরিবারের প্রধানদের ঐতিহাসিক প্রভাব

মারমা সমাজে পরিবার ও গ্রাম প্রধানদের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে তারা প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন।

মারমাদের উৎসব 

মারমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উৎসবগুলি সাধারণত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। এখানে কয়েকটি প্রধান মারমা উৎসবের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো, 

বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য এবং মারমাদের উৎসব

সাংগ্রাই (Songkran) উৎসব

সাংগ্রাই মারমা জাতির সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় উৎসব। এটি তাদের নতুন বছর উদযাপন উপলক্ষে পালিত হয় এবং সাধারণত এপ্রিল মাসে হয়।

  • পানির খেলায় মেতে ওঠা: এই উৎসবের সবচেয়ে জনপ্রিয় দিক হল পানি খেলা। মানুষজন একে অপরের উপর পানি ছিটিয়ে নতুন বছরের আগমন উদযাপন করে। এটি তাদের বিশ্বাস যে পানির ছিটানো পবিত্রতা আনে এবং পুরানো বছর থেকে সমস্ত মন্দ দূর করে দেয়।
  • বুদ্ধ পূজা: মারমা জনগণ বুদ্ধের মূর্তি ধৌত করেন এবং প্রার্থনা করেন। এছাড়াও তারা মন্দিরে গিয়ে ফুল, ধূপ এবং মোমবাতি দিয়ে পূজা করেন।
  • সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: সাংগ্রাই উৎসবের সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় যেখানে মারমা নাচ, গান এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে প্রদর্শন করা হয়।

ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (Wagyway Pwe)

  • ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে বা “জল উৎসব” হল মারমা ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবগুলির মধ্যে একটি। এটি ধান কাটার মৌসুম শেষে উদযাপিত হয়।
  • জল অভিষেক: এই সময়ে মারমা জনগণ নিজেদের শুদ্ধ করতে এবং পবিত্রতা অর্জনের জন্য মন্দিরে গিয়ে বুদ্ধের মূর্তিতে জল ঢালেন। এই উৎসবের মূল লক্ষ্য হল শুদ্ধতা ও পবিত্রতা অর্জন করা।
  • ধর্মীয় রীতিনীতি: উৎসবের সময় মঠে গিয়ে পূজা এবং ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

বুদ্ধ পূর্ণিমা

  • বুদ্ধ পূর্ণিমা মারমা জাতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব যা বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান উৎসবগুলির মধ্যে একটি। এটি গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বোধি লাভ এবং মহাপরিনির্বাণের স্মরণে উদযাপিত হয়।
  • মন্দিরে পূজা: এই দিনে মারমা জনগণ মন্দিরে গিয়ে বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পূজা করেন।
  • বিশেষ উপবাস: অনেক মারমা জনগণ এই দিনে উপবাস করেন এবং ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করেন।

কাসিয়াং বা পোঙী (Kashang/Pongi)

  • কাসিয়াং হল মারমাদের ঐতিহ্যবাহী নববর্ষ উৎসব। এটি বছরের প্রথম দিন উদযাপিত হয় এবং সাধারণত মঙ্গলে পালিত হয়।
  • নববর্ষ উদযাপন: মারমা জনগণ এই দিনে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বিশেষভাবে সাজিয়ে রাখেন এবং বুদ্ধের পূজা করেন।
  • খাবার ও পানীয়: এই দিনে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মারমা খাবার এবং পানীয় পরিবেশন করা হয়।

ওয়া পূজা (Owa Puja)

  • ওয়া পূজা হল মারমাদের আরেকটি ধর্মীয় উৎসব যা মূলত বুদ্ধের জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে স্মরণ করাতে উদযাপিত হয়।
  • ধর্মীয় শিক্ষা: এই দিনে মন্দিরে বুদ্ধের জীবন ও শিক্ষার উপর আলোচনা হয় এবং মারমা জনগণ সেগুলি শ্রদ্ধার সাথে শ্রবণ করেন।
  • ধর্মীয় রীতিনীতি: মঠে গিয়ে ধর্মীয় উপাসনা করা এবং ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা হয়। 

মান্দাল পূজা (Mandala Puja)

  • এটি একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেখানে বুদ্ধের মূর্তি তৈরি করা হয় এবং তাকে মান্দাল বা বিশেষ ধর্মীয় চিহ্ন দিয়ে সাজানো হয়।
  • মূর্তি সাজানো: এই দিনে মারমা জনগণ বুদ্ধের মূর্তিকে বিভিন্ন ফুল ও পবিত্র বস্তু দিয়ে সাজিয়ে রাখেন।
  • ধর্মীয় অনুষ্ঠান: পূজা ও ধ্যানের মাধ্যমে বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

মারমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও খাদ্য

মারমাদের উৎসবগুলিতে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান একটি সাধারণ প্রথা। তারা রঙিন এবং সমৃদ্ধ কাপড় পরে থাকে যা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে প্রতিফলিত করে। এছাড়া তাদের উৎসবগুলিতে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন মাংস, ভাত এবং বিভিন্ন ধরনের নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হয়।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব

মারমা উৎসবগুলি শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয় এটি তাদের সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে জীবিত রাখে। এই উৎসবগুলি তাদের সমাজে একতাবদ্ধতা এবং আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে দেয়।

মারমা জাতির উৎসবগুলি তাদের ঐতিহ্যবাহী এবং ধর্মীয় জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যা তাদের সমাজকে সমৃদ্ধ করে এবং তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সংরক্ষণ করে।

লেখকের মন্তব্য

মারমা সম্প্রদায় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যতম প্রধান আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং নিজস্ব মারমা ভাষায় কথা বলে। তাদের সংস্কৃতি ও রীতিনীতিতে বিশেষ করে থাই, বর্মী এবং ত্রিপুরা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মারমা সম্প্রদায় ঐতিহ্যবাহী নাচ, গান, এবং উৎসবের মাধ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখে। 

কৃষিকাজ, হাতশিল্প এবং বুননশিল্পে পারদর্শী এই সম্প্রদায় দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অংশ তাই সরকারের উচিত এদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া। আজকের পোস্টটি আপনাদের ভালো লেগে থাকলে পেইজটি ফলো করুন এবং পরিচিতজনদের সাথে শেয়ার করুন।  

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url